পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরভাগ | দ্বাদশ শ্রেণী | সমস্ত প্রশ্ন উত্তর

পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরভাগ

পৃথিবীর সৃষ্টি তত্ত্ব থেকে আমরা জানতে পারি, আদিকালে পৃথিবী ছিল একটি জ্বলন্ত গ্যাসপিন্ড, যা কালক্রমে তাপ বিকিরণের মাধ্যমে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে বর্তমান রূপ ধারন করেছে। পৃথিবীর একেবারে উপরিস্তরে বসবাসকারী মানুষ, সুপ্রাচীনকাল থেকে ভূ - আভ্যন্তরীন গঠন সম্পর্কে বিবিধ ধারনা ও বিশ্লেষণ পোষণ করে এসেছে। আধুনিককালে, বিজ্ঞান ও ভূগোলের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে, পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারনা পরিস্ফূট হয়েছে। ৬৩৭১ কিমি ব্যাসার্ধযুক্ত পৃথিবী প্রধানত -- লৌহ (৩২.১%), অক্সিজেন (৩০.১%), সিলিকা (১৫.১%), ম্যাগনেসিয়াম (১৩.৯%), সালফার (২.৯%), নিকেল (১.৮%), ক্যালসিয়াম (১.৫%), অ্যালুমিনিয়াম (১.২%) প্রভৃতি পদার্থ দ্বারা গঠিত। পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগের গঠন সম্পর্কে আমরা দুইপ্রকার তথ্য বিশ্লেষণ করে থাকি -- ১) প্রত্যক্ষ তথ্যঃ- সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যগুলিকে প্রত্যক্ষ তথ্য বলে। যেমন -- ভূগর্ভস্থ খনি, অগ্ন্যুৎপাত, সমুদ্রগর্ভে গর্ত খনন (Drilling) প্রভৃতি।
২) পরোক্ষ তথ্যঃ- বৈজ্ঞানিক গবেষণাকৃত ধারনা থেকে প্রাপ্ত, সরাসরি পর্যবেক্ষিত নয় -- তথ্যগুলিকে পরোক্ষ তথ্য বলে। যেমন -- পৃথিবীর ঘনত্ব, ভূগর্ভস্থ উষ্ণতা ও চাপ, ভূকম্প তরঙ্গের গতিপ্রকৃতি প্রভৃতি।
প্রত্যক্ষ তথ্যগুলি থেকে, পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে অতি অল্প ধারনা করা যায়। বর্তমানে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ গঠন বিন্যাস 'ভূকম্প তরঙ্গের গতিপ্রকৃতি'-এর দ্বারা পর্যালোচনা করা হয়। তাই, পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে, ভূকম্প তরঙ্গ সম্পর্কে সম্যক অধ্যয়ন করা অতি আবশ্যক। নীচে ভূকম্প তরঙ্গ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।



    পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরভাগ | দ্বাদশ শ্রেণী | সমস্ত প্রশ্ন উত্তর
    চিত্র: তৃতীয় পক্ষের রেফারেন্স

    ভূতরঙ্গের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ-

    ভূগর্ভের কোনো স্থানে, ভূমিকম্পের সময় সৃষ্ট তরঙ্গকে 'ভূকম্প তরঙ্গ' বা Seismic Wave বলে। ১৭৫৫ সালের ১লা নভেম্বর, ভূকম্প বিশারদ জন মিশেল পর্তুগালের লিসবনে সর্বপ্রথম ভূকম্প তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। ভূকম্প তরঙ্গ প্রধানত দুই প্রকার --

    ১) দেহ তরঙ্গ (Body Wave):- 

    যেসব ভূকম্প তরঙ্গ পৃথিবীর গঠনকারী পদার্থের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাদের দেহ তরঙ্গ বা অভ্যন্তরস্থ তরঙ্গ বা Body Wave বলে। দেহ তরঙ্গ দুই প্রকার--

    I) প্রাথমিক তরঙ্গ (Primary Wave):- 

    ভূগর্ভে পদার্থের মধ্য দিয়ে ক্রম সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে শব্দ তরঙ্গের অনুরূপ ভাবে, যে ভূকম্প তরঙ্গ সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়, তাকে প্রাথমিক তরঙ্গ/সংনমন তরঙ্গ/অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ/Primary Wave/P-Wave বলে।
    বৈশিষ্ট্যঃ- ১) ইহা দ্রুততম ভূকম্প তরঙ্গ। গড় গতিবেগ ৬-৮ কিমি/সেকেন্ড। ২) তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলি তরঙ্গের দিকেই অগ্রসর হয়। ৩) কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। যদিও তরল ও গ্যাসীয় মাধ্যমে এর গতিবেগ হ্রাস পায়।৪) ইহা শব্দ তরঙ্গের ন্যায় প্রবাহিত হয়।

    II) গৌণ তরঙ্গ (Secondary Wave):-

    ভূগর্ভে বস্তুকণার ওপর নীচে ওঠানামার মাধ্যমে, যে ভূকম্প তরঙ্গ শুধুমাত্র কঠিন মাধ্যমে প্রবাহিত হয়, তাকে গৌণ তরঙ্গ/তির্যক তরঙ্গ/অনুপ্রস্থ তরঙ্গ/Secondary Wave/Shear Wave/S-Wave বলে।
    বৈশিষ্ট্যঃ- ১) ইহা প্রাথমিক তরঙ্গের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম গতিবেগ সম্পন্ন হয়। গড় গতিবেগ ৪.৫-৫ কিমি/সেকেন্ড। ২) তরঙ্গ মাধ্যমের কণাগুলি তরঙ্গের গতির সাথে আড়াআড়িভাবে বা সমকোনে অগ্রসর হয়। ৩) শুধুমাত্র কঠিন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। তরল বা গ্যাসীয় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় না। ৪) ইহা আলোক তরঙ্গের ন্যায় প্রবাহিত হয়।

    ২) পৃষ্ঠ তরঙ্গ (Surface Wave):-

     যেসব ভূকম্প তরঙ্গ ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠ বরাবর ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে, তাদের পৃষ্ঠ তরঙ্গ বা ভূত্বকীয় তরঙ্গ বা Surface Wave বলে। পৃষ্ঠ তরঙ্গ দুই প্রকার -- I) লাভ তরঙ্গ/Lq তরঙ্গ/Love Wave এবং II) রেলেহ্ তরঙ্গ/Lr তরঙ্গ/Rayleigh Wave।
    বৈশিষ্ট্যঃ- ১) ইহা সবচেয়ে কম গতিবেগ সম্পন্ন ভূকম্প তরঙ্গ। গড় গতিবেগ ৩.৫-৪ কিমি/সেকেন্ড। ২) পৃষ্ঠ তরঙ্গের 'লাভ তরঙ্গ' -- বস্তুকণার ওপর নীচে ওঠানামার মাধ্যমে এবং 'রেলেহ্ তরঙ্গ' -- বস্তুকনার ওপর নীচে ওঠানামা ও সংকোচন - প্রসারণের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। ৩) পৃষ্ঠ তরঙ্গের কম্পাঙ্ক সবচেয়ে কম এবং তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি হয়। ৪) ইহা সর্বাধিক ক্ষয়ক্ষতি সাধনকারী ভূকম্প তরঙ্গ।
    [[ব্রিটিশ পদার্থবিদ রিচার্ড ডিক্সন ওল্ডহ্যাম সর্বপ্রথম P Wave, S Wave ও পৃষ্ঠ তরঙ্গ পৃথকভাবে চিহ্নিত করেন।]]
    [[পদার্থবিদ A. E. H. Love এর নামানুসারে 'Love Wave' এবং পদার্থবিদ Lord Rayleigh এর নামানুসারে 'Rayleigh Wave' নামকরন করা হয়।]]

    ভূকম্প তরঙ্গের মাধ্যমে ভূ - আভ্যন্তরীণ গঠন নির্ণয়ঃ-

    ভূ - অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত প্রাথমিক (P Wave) ও গৌণ (S Wave) ভূকম্প তরঙ্গের প্রতিফলন ও প্রতিচসরণের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরের স্তরবিন্যাস জানা যায়। এই বিষয়ে ডাচ বিজ্ঞানী Willebrord Snell এর 'প্রতিসরণ সূত্র' বা Snell's Law বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভূ - অভ্যন্তরে পদার্থের ঘনত্ব ও বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হলে, প্রাথমিক ও গৌণ তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। এক ঘনত্বের শিলাস্তর থেকে পৃথক ঘনত্বের শিলাস্তরের ভিতর দিয়ে প্রবাহের সময় প্রাথমিক ও গৌণ তরঙ্গের গতিপথ পরিবর্তিত হয়। এই গতিপথ পরিবর্তনের মান তরঙ্গের গতির ওপর নির্ভর করে। তরঙ্গের গতি আবার পদার্থ বা শিলাস্তরের ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে। এইভাবে প্রতিফলন ও প্রতিসরণ কোনের মান থেকে, ভূ - অভ্যন্তরের বিভিন্ন পদার্থের সমন্বয়, স্তরবিশেষে পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্য জানা যায়।

    ছায়া অঞ্চলঃ-

     পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ ও ঘনত্ব যুক্ত হওয়ার ফলে, ভূকম্প কেন্দ্রের উলটো দিকের কিছুটা অঞ্চলে (প্রাথমিক তরঙ্গ ১০৪-১৪০ ডিগ্রি ও গৌণ তরঙ্গ অনুর্দ্ধ১০৪ ডিগ্রি) কোনোপ্রকার ভূকম্প তরঙ্গ দেখা যায় না। একে ছায়া অঞ্চল বা ছায়া বলয় বা Shadow Zone বলে। প্রাথমিক তরঙ্গ ও গৌণ তরঙ্গের দ্বারা সৃষ্ট ছায়া বলয়ের পরিমাণ যথাক্রমে -- ২৬.৫% ও ৩৭%। ভূকম্প তরঙ্গের ছায়া অঞ্চলের রৈখিক দূরত্ব হল ১১,৫৪০-১৫,৯৪০ কিমি।

    পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ স্তরবিন্যাসঃ-

    ভূকম্প তরঙ্গের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে, পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ গঠনকে ৩ টি প্রধান স্তরে বিভক্ত করা হয় ---
    A) ভূত্বক বা Crust
    B) গুরুমন্ডল বা Mantle
    C) কেন্দ্রমন্ডল বা Core
    পৃথিবীর মোট আয়তনের(Volume) ১% ভূত্বক ; ৮৪% গুরুমন্ডল এবং ১৫% কেন্দ্রমন্ডল অধিকার করে রয়েছে।
    আবার, পৃথিবীর মোট ভরের (Mass) ০.৪৫% ভূত্বক ; ৬৭.০৫% গুরুমন্ডল ও ৩২.৫০% কেন্দ্রমন্ডল অধিকার করে রয়েছে।
    উনিশ শতকে অস্ট্রিয়ান ভূতত্ত্ববিদ এডওয়ার্ড সুয়েস সর্বপ্রথম পৃথিবীর আভ্যন্তরীন গঠনের ত্রি-স্তরীয় বিন্যাস (সিয়াল, সিমা ও নিফে)-এর কথা বলেন।

    A) ভূত্বক(Crust):-

     পৃথিবীর উপরিভাগে যে কঠিন, হালকা ও পাতলা শিলাস্তরটি শামুকের খোলার ন্যায় পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে, তাকে ভূত্বক বা Crust বলে। ভূত্বক বা Crust বলতে বোঝায় -- "The outermost solid shell of a rocky planet or natural satellite, which have been generated largely by the Igneous Processes, & which is chemically distinct from the underlying Mantle." ভূত্বকের একেবারে উপরের যে পাতলা মৃত্তিকাস্তর অংশটি মাটি, বালি, পাথর প্রভৃতি দ্বারা গঠিত, তাকে ভূপৃষ্ঠ বা Surface বলে।
    ভূত্বক প্রধানত দুই প্রকার--
    ১) মহাদেশীয় ভূত্বক বা সিয়াল(Continental Crust Or Sial) এবং ২) মহাসাগরীয় ভূত্বক (Oceanic Crust Or Sima)।

    ১) মহাদেশীয় ভূত্বকঃ-

     ভূত্বকের সবচেয়ে হালকা ও ওপরের অংশ, যা প্রধানত আম্লিক শিলা দ্বারা গঠিত, তাকে মহাদেশীয় ভূত্বক বলে। মহাদেশীয় ভূত্বক প্রধানত সিলিকা ও অ্যালুমিনিয়াম দ্বারা গঠিত বলে, এই স্তরকে 'সিয়াল' ('Si'lica+'Al'minium =Sial) বলা হয়। এডওয়ার্ড সুয়েস এই নামকরন করেন। মহাদেশীয় ভূত্বকের গভীরতা ২০-৭০ কিমি। উপকূল অঞ্চল থেকে মহাদেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের দিকে মহাদেশীয় ভূত্বকের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এশিয়া মহাদেশের তিব্বতের নীচে মহাদেশীয় ভূত্বকের গভীরতা সর্বাধিক। মহাদেশীয় ভূত্বকের গড় ঘনত্ব ২.৭-২.৮ গ্রাম/ঘনসেমি। মহাদেশীয় ভূত্বকের প্রধান রাসায়নিক উপাদানগুলি হল -- সিলিকা (৬০.২%), অ্যালুমিনিয়াম (১৫.২%), চুন (৫.৫%), আয়রন অক্সাইড FeO (৩.৮%), ম্যাগনেসিয়াম (৩.১%), সোডিয়াম অক্সাইড (৩.০%), পটাশিয়াম অক্সাইড (২.৮%), আয়রন অক্সাইড Fe2O3 (২.৫%), জল (১.৪%), কার্বন ডাই অক্সাইড (১.২%) প্রভৃতি। মহাদেশীয় ভূত্বকের প্রধান খনিজ উপাদানগুলি হল -- প্ল্যাজিওক্লজে (৩৯%), কোয়ার্জ (১২%), K-ফেল্ডস্পার (১২%), পাইরক্সিন (১১%), অ্যাম্ফিবোল (৫%) প্রভৃতি। মহাদেশীয় ভূত্বক বা সিয়াল প্রধানত আম্লিক জাতীয় শিলা দ্বারা গঠিত। মহাদেশীয় ভূত্বকের প্রধান শিলাগুলি হল -- গ্র্যানাইট (সর্বপ্রধান), অ্যান্ডিসাইট, টোনালাইট, রায়োলাইট, গ্র্যানোডায়োরাইট, ডায়োরাইট, অ্যাম্ফিবোলাইট, গার্নেট গ্র্যানুলাইট প্রভৃতি।
    মহাদেশীয় ভূত্বকে P Wave-এর গতিবেগ ৬.২ কিমি/সেকেন্ড ও S Wave-এর গতিবেগ ৩-৪ কিমি/সেকেন্ড।

    কনরাড বিযুক্তিরেখাঃ-

    ভূগর্ভে যে পরিবর্তনশীল অঞ্চল ভূগর্ভস্থ দুটি স্তরকে পৃৃথক করে, তাকে বিযুক্তিরেখা বা Discontinuity Line বলে। ভূত্বকের দুইটি অংশ মহাদেশীয় ভূত্বক (সিয়াল) এবং মহাসাগরীয় ভূত্বক (সিমা) এর মাঝে একটি বিযুক্তিরেখা রয়েছে, যা কনরাড বিযুক্তিরেখা (Conrad Discontinuity Line) নামে পরিচিত। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৫-২০ কিমি গভীরতায়, শুধুমাত্র মহাদেশীয় ভূত্বকের নীচে এই বিযুক্তিরেখা দেখা যায়। ১৯২৫ সালে অস্ট্রিয়ান - আমেরিকান ভূকম্পবিদ ভিক্টর কনরাড এটি আবিষ্কার করেন। তাই তাঁর নামানুসারে, এটি কনরাড বিযুক্তিরেখা নামে পরিচিত।

    ২)মহাসাগরীয় ভূত্বকঃ- 

    মহাদেশীয় ভূত্বকের নীচে, অপেক্ষাকৃত ভারী অংশ, যা প্রধানত ক্ষারকীয় শিলা দ্বারা গঠিত, তাকে মহাসাগরীয় ভূত্বক বলে। মহাসাগরীয় ভূত্বক প্রধানত সিলিকা ও ম্যাগনেসিয়াম দ্বারা গঠিত বলে, এই স্তরকে 'সিমা' ('Si'lica + 'Ma'gnesium = Sima) বলা হয়। এডওয়ার্ড সুয়েস এই নামকরন করেন।
    মহাসাগরীয় ভূত্বকের গভীরতা ৫-১০ কিমি এবং গড় ঘনত্ব ২.৯-৩.৩ গ্রাম /ঘনসেমি। মহাসাগরীয় ভূত্বকের প্রধান রাসায়নিক উপাদানগুলি হল -- সিলিকা (৪৮.৬%), অ্যালুমিনিয়াম (১৬.৫%), চুন (১২.৩%), ম্যাগনেসিয়াম (৬.৮%), আয়রন অক্সাইড FeO (৬.২%), সোডিয়াম অক্সাইড (২.৬%), আয়রন অক্সাইড Fe2O3 (২.৩%), কার্বন ডাই অক্সাইড (১.৪%), টাইটানিয়াম ডাইঅক্সাইড (১.৪%) প্রভৃতি। মহাসাগরীয় ভূত্বকের প্রধান খনিজ
    উপাদানগুলি হল -- প্ল্যাজিওক্লজে, পাইরক্সিন, অলিভিন, ম্যাগনেটাইট প্রভৃতি। মহাসাগরীয় ভূত্বক বা সিমা প্রধানত ক্ষার জাতীয় শিলা দ্বারা গঠিত। মহাসাগরীয় ভূত্বকের প্রধান শিলাগুলি হল -- ব্যাসাল্ট (সর্বপ্রধান), গ্যাব্রো, ডায়াবেস, প্যালাগোনাইট, স্কোরিয়া প্রভৃতি। মহাসাগরীয় ভূত্বকে P Wave-এর গতিবেগ ৬.৯ কিমি/সেকেন্ড ও S Wave-এর গতিবেগ ৪-৫ কিমি/সেকেন্ড।

    ভূত্বক সম্পর্কিত কিছু তথ্যঃ-
    **সিয়াল স্তরকে গ্রানাইট স্তর এবং সিমা স্তরকে ব্যাসাল্ট স্তর বলে।
    **ভূত্বকের গড় উষ্ণতা ২০০-৪০০ ডিগ্রি C।
    **পৃথিবীর মোট ভরের ০.৩৭৪% মহাদেশীয় ভূত্বক ও ০.০৯৯% মহাসাগরীয় ভূত্বক অধিকার করে রয়েছে।
    **বর্তমানে পৃথিবীর মহাদেশীয় ভূত্বকের গড় বয়স আনুমানিক ২ বিলিয়ন বছর।

    মোহো বিযুক্তিরেখাঃ-

    ভূগর্ভে যে পরিবর্তনশীল অঞ্চল ভূগর্ভস্থ দুটি স্তরকে পৃৃথক করে, তাকে বিযুক্তিরেখা বা Discontinuity Line বলে। ভূত্বক (মহাসাগরীয় ভূত্বক বা সিমা) ও গুরুমন্ডলের মাঝে একটি বিযুক্তিরেখা রয়েছে, যা মোহো বিযুক্তিরেখা (Moho Discontinuity Line) নামে পরিচিত। মহাদেশের নীচে ৩৫-৭০ কিমি গভীরতায় এবং মহাসাগরের নীচে ৫-১০ কিমি গভীরতায় এই বিযুক্তিরেখা দেখা যায়। ১৯০৯ সালে ক্রোয়েশিয়ার ভূকম্পবিদ আন্দ্রিজাঁ মোহোরোভিসিক এটি আবিষ্কার করেন। তাই তার নাম অনুসারে এটি মোহো বিযুক্তিরেখা নামে পরিচিত।

    B) গুরুমন্ডল (Mantle):-

      ভূত্বকের নীচ থেকে কেন্দ্রমন্ডলের উপরিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত, লোহা ও ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ ভারী সিলিকেট খনিজ পদার্থ দ্বারা গঠিত স্তরটিকে গুরুমন্ডল বা Mantle বলে। গুরুমন্ডল বা Mantle বলতে বোঝায় -- A layer inside a terrestrial planet and some other rocky planetary bodies by the process of planetary differentiation by density."
    গুরুমন্ডল প্রধানত দুইটি অংশে বিভক্ত -- ১) উর্দ্ধ গুরুমন্ডল (Upper Mantle) ও ২) নিম্ন গুরুমন্ডল (Lower Mantle)।

    ১) উর্দ্ধ গুরুমন্ডলঃ-

     ভূগর্ভে মোহো বিযুক্তিরেখা থেকে প্রায় ৯০০-১০০০ কিমি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত,  গুরুমন্ডলের উপরের অংশটিকে উর্দ্ধগুরুমন্ডল বা Upper Mantle বলে। উর্দ্ধগুরুমন্ডল প্রধানত ক্রোমিয়াম, লোহা, সিলিকা ও ম্যাগনেসিয়াম দ্বারা গঠিত বলে, ইহা "ক্রোফেসিমা" (CroFeSiMa) নামেও পরিচিত। উর্দ্ধগুরুমন্ডল -এর প্রধান খনিজ উপাদানগুলি হল -- অলিভিন, পাইরক্সিন, স্পিনেল, গার্নেট প্রভৃতি এবং প্রধান শিলাগুলি হল -- পেরিডোটাইট, ডিউনাইট, একলোজাইট প্রভৃতি। উর্দ্ধগুরুমন্ডল -এর গড় ঘনত্ব হল ৩.৪ - ৪.৫ গ্রাম/ঘনসেমি।
    উর্দ্ধ গুরুমন্ডল আবার ৩ টি উপস্তরে বিভক্ত --
    A) সর্বোচ্চ উর্দ্ধ গুরুমন্ডল (Upper Most Mantle) B) ক্ষুব্ধমন্ডল (Asthenosphere) C) পরিবর্তনশীল অঞ্চল (Transition Zone)।

    A) সর্বোচ্চ উর্দ্ধ গুরুমন্ডলঃ- গুরুমন্ডলের সবচেয়ে উপরের স্তর, যা ঠিক মোহো বিযুক্তিরেখার নীচে অবস্থিত। এই স্তরটির গভীরতা ভূগর্ভে ৩০-৮০ কিমি। এই স্তরে পদার্থ খুব কঠিন অবস্থায় থাকে। মহাদেশীয় ভূত্বক, মহাসাগরীয় ভূত্বক ও সর্বোচ্চ উর্দ্ধ গুরুমন্ডলকে একত্রে শিলামন্ডল বা Lithosphere বলে। এই অঞ্চলে P Wave-এর গতিবেগ ৮-৮.৫ কিমি/সেকেন্ড ও S Wave-এর গতিবেগ ৬-৭ কিমি/সেকেন্ড।

    শিলামন্ডল - ক্ষুব্ধমন্ডল সীমানাঃ-

    সর্বোচ্চ উর্দ্ধ গুরুমন্ডলের ঠিক নীচে যে সীমানা ভূগর্ভে শিলামন্ডল ও ক্ষুব্ধমন্ডলকে পৃথক করেছে, তাকে শিলামন্ডল - ক্ষুব্ধমন্ডল সীমানা (Lithosphere - Asthenosphere Boundary / L.A.B.) নামে পরিচিত। মহাসাগরীয় ভূত্বকে নীচে ৫০-১৪০ কিমি গভীরতায় এই সীমানা দেখা যায়। শুধুমাত্র মধ্য সামুদ্রিক শৈলশিরা অঞ্চলের নবীন ভূত্বক গঠন অঞ্চলে এই সীমানা নবীন ভূত্বকের ঠিক নীচেই অবস্থান করে।


    B) ক্ষুব্ধমন্ডলঃ- 

    ভূগর্ভে সর্বোচ্চ উর্দ্ধ গুরুমন্ডলের ঠিক নীচে, ৮০-২০০ কিমি (কখনো কখনো ৭০০ কিমি পর্যন্ত) গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত, গুরুমন্ডলের সান্দ্র ও গাঠনিকভাবে দুর্বল স্তরটিকে ক্ষুব্ধমন্ডল বা Asthenosphere বলে। Asthenosphere শব্দটি গ্রীক শব্দ 'Asthenes' থেকে এসেছে, যার অর্থ হল -- দুর্বল বা Weak। ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ জে. ব্যারেল, ১৯১৪ সালে এই স্তর সম্পর্কে সর্বপ্রথম আলোকপাত করেন এবং Asthenosphere নামকরন করেন। এই স্তরে শিলা গলনাঙ্কের কাছাকাছি থাকে। ক্ষুব্ধমন্ডলে P ও S Wave-এর গতিবেগ হ্রাস পায়। এই স্তরে P Wave-এর গতিবেগ ৭ কিমি/সেকেন্ড ও S Wave-এর গতিবেগ ৩-৪ কিমি/সেকেন্ড। ভূকম্প তরঙ্গের গতিবেগ হ্রাস পাওয়ার জন্য একে Low Velocity Zone (L.V.Z.) বলে। অনুমান করা হয়, এই অঞ্চলের পেরিডোটাইট শিলায় ০.১% জল অবস্থান করছে। এই গভীরতায় ভূগর্ভের তাপে ও চাপে এবং জলের উপস্থিতিতে অন্তত ৫% পেরিডোটাইট শিলা গলে যায়। এইভাবে স্তরটি সান্দ্রতা প্রাপ্ত হয়।
    C)পরিবর্তনশীল অঞ্চলঃ- উর্দ্ধ গুরুমন্ডলে ক্ষুব্ধমন্ডলের নীচ থেকে প্রায় ৯০০-১০০০ কিমি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটি পরিবর্তনশীল অঞ্চল বা Transition Zone নামে পরিচিত। এই অঞ্চলটি ক্ষুব্ধমন্ডলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কঠিন অবস্থায় রয়েছে। তাই এই অঞ্চলে P ও S Wave-এর গতিবেগ পুনরায় বৃদ্ধি পায়। পরিবর্তনশীল অঞ্চলে P Wave-এর গতিবেগ ৭-৮ কিমি/সেকেন্ড ও S Wave-এর গতিবেগ ৪-৫ কিমি/সেকেন্ড।

    রেপটি বিযুক্তিরেখাঃ-

    ভূগর্ভে যে পরিবর্তনশীল অঞ্চল ভূগর্ভস্থ দুটি স্তরকে পৃথক করে, তাকে বিযুক্তিরেখা বা Discontinuity Line বলে। উর্দ্ধ গুরুমন্ডল ও নিম্নগুরুমন্ডলের মাঝে একটি বিযুক্তিরেখা রয়েছে, যা রেপটি বিযুক্তিরেখা (Repetti Discontinuity Line) নামে পরিচিত। ভূগর্ভে ৯০০-১০০০ কিমি গভীরতায় এই বিযুক্তিরেখা দেখা যায়। ১৯৩০ সালে আমেরিকান ভূতত্ত্ববিদ উইলিয়াম সি. রেপটি এটি আবিষ্কার করেন। তাই তার নাম অনুসারে এটি রেপটি বিযুক্তিরেখা নামে পরিচিত।

    ২) নিম্নগুরুমন্ডলঃ- 

    ভূগর্ভে রেপটি বিযুক্তিরেখা থেকে প্রায় ২৮৯০ কিমি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত, গুরুমন্ডলের নিচের অংশটিকে নিম্নগুরুমন্ডল বা Lower Mantle বলে। নিম্নগুরুমন্ডল প্রধানত নিকেল, লোহা, সিলিকা ও ম্যাগনেসিয়াম দ্বারা গঠিত বলে, ইহা "নিফেসিমা" (NiFeSiMa) নামেও পরিচিত। নিম্নগুরুমন্ডলের প্রধান খনিজ উপাদানগুলি হল -- পলি-মর্ফস্, ওয়াডস্লেয়াইট, রিংউডাইট প্রভৃতি এবং উচ্চ চাপজনিত অবস্থায় সৃষ্ট প্রধান  শিলাখনিজ গুলি হল -- সিলিকেট পেরোভস্কাইট, ফেরো পেরিক্লজ, ম্যাগনেসিয়াম সিলিকেট প্রভৃতি। নিম্নগুরুমন্ডলের গড় ঘনত্ব হল ৪.৫ - ৫.৫ গ্রাম/ঘনসেমি।
    নিম্নগুরুমন্ডল আবার ৩ টি উপস্তরে বিভক্ত --
    A) D-১ স্তর (D-1 Layer)ও B) D-২ স্তর (D-2 Layer)।

    A) D-১ স্তরঃ- এটি নিম্নগুরুমন্ডলের সবচেয়ে উপরের স্তর। D-১ স্তরটি ৯০০-১০০০ থেকে ২৭০০-২৭৪০ কিমি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত। ভূকম্প তরঙ্গের অতি পরিবর্তনশীল গতিবেগ থেকে এই অঞ্চলের পরিবর্তনশীল ঘনত্ব সম্পর্কে ধারনা করা যায়। এই স্তরে P Wave-এর গতিবেগ ৮-৯ কিমি/সেকেন্ড ও S Wave-এর গতিবেগ ৫-৬ কিমি/সেকেন্ড।

    B) D-২ স্তরঃ- এটি নিম্নগুরুমন্ডলের সবচেয়ে নিচের স্তর। D-২ স্তরটি ২৭০০-২৭৪০ থেকে ২৮৯০ কিমি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তর D-১ স্তরের চেয়ে অনেক বেশি উষ্ণ। D-২ স্তরের উষ্ণতা প্রায় ১৭০০-১৮০০ ডিগ্রি C। এই অঞ্চলে প্রতিনিয়ত প্রচন্ড শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। এই বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট অতি উষ্ণ ব্যাসাল্টিক ম্যাগমা কখনো কখনো ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত প্রসারিত হয় ও ভূপৃষ্ঠে Hot Spot সৃষ্টি করে। তাই D-২ স্তরকে Hot Spot এর উৎস অঞ্চল বলা হয়। এই স্তর পৃথিবীর চৌম্বকীয় ধর্মের ওপর অত্যধিক প্রভাব বিস্তার করে। D-২ স্তরে P Wave-এর গতিবেগ ৯-১০ কিমি/সেকেন্ড ও S Wave-এর গতিবেগ ৬-৭ কিমি/সেকেন্ড।

    গুটেনবার্গ বিযুক্তিরেখাঃ-

    ভূগর্ভে যে পরিবর্তনশীল অঞ্চল ভূগর্ভস্থ দুটি স্তরকে পৃৃথক করে, তাকে বিযুক্তিরেখা বা Discontinuity Line বলে। গুরুমন্ডল ও কেন্দ্রমন্ডলের মাঝে একটি বিযুক্তিরেখা রয়েছে, যা গুটেনবার্গ  বিযুক্তিরেখা (Gutenberg  Discontinuity Line) নামে পরিচিত। ভূগর্ভে ২৮৯০-২৯০০ কিমি গভীরতায় এই বিযুক্তিরেখা দেখা যায়। ১৮৯৭ সালে জার্মান ভূতত্ত্ববিদ এমিল উইচার্ট ও ১৯১২ সালে জার্মান ভূতত্ত্ববিদ বেনো গুটেনবার্গ এই বিযুক্তিরেখা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তাই তাদের নাম অনুসারে এটি গুটেনবার্গ  বিযুক্তিরেখা বা উইচার্ট - গুটেনবার্গ বিযুক্তিরেখা নামে পরিচিত। একে কেন্দ্রমন্ডল - গুরুমন্ডল সীমানা (Core - Mantle Boundary / C.M.B.) নামেও পরিচিত। উল্লেখ্য, ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ রিচার্ড ওল্ডহ্যাম পৃথিবীর কেন্দ্রমন্ডলের অবস্থান চিহ্নিত করেন ও কেন্দ্রমন্ডল - গুরুমন্ডল সীমানা সম্পর্কে আংশিক ধারনা প্রদান করেন। যদিও ওল্ডহ্যামের এই ধারনার গাণিতিক রূপ পুরোপুরি সঠিক ছিলনা। অনেকে, তাই এই বিযুক্তিরেখাকে ওল্ডহ্যাম - গুটেনবার্গ বিযুক্তিরেখা নামে চিহ্নিত করেন।

    C) কেন্দ্রমন্ডল(Core):- 

    গুরুমন্ডলের নিচে, গুটেনবার্গ বিযুক্তিরেখা থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত (অর্থাৎ ৬৩৭১ কিমি গভীরতা পর্যন্ত) ভারী ধাতব পদার্থ দ্বারা গঠিত, সবচেয়ে উষ্ণ ও সর্বাধিক ঘনত্বযুক্ত অংশটিকে কেন্দ্রমন্ডল বা Core বলে। অনেকে এই অঞ্চলটিকে Barysphere নামেও চিহ্নিত করেন।   কেন্দ্রমন্ডল প্রধানত নিকেল ও লোহা দ্বারা গঠিত বলে, ইহা "নিফে" (NiFe) নামেও পরিচিত। কেন্দ্রমন্ডলের প্রধান খনিজ উপাদানগুলি হল -- লোহা, নিকেল, সালফার, সোনা, প্ল্যাটিনাম, ইউরেনিয়াম, অক্সিজেন প্রভৃতি। কেন্দ্রমন্ডল বা  Core বলতে বোঝায় -- " The part of Earth in the middle of our planet which has a solid inner region & a liquid outer region, made by dense metalic elements, specially by Iron & Nickel."
    কেন্দ্রমন্ডল প্রধানত দুইটি অংশে বিভক্ত -- ১) বহিঃকেন্দ্রমন্ডল (Outer Core) এবং ২) অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডল (Inner Core)।

    ১) বহিঃকেন্দ্রমন্ডলঃ-

     ভূগর্ভে  ২৮৯০-৫১৫০ কিমি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত কেন্দ্রমন্ডলের তরল অবস্থাপ্রাপ্ত অংশটিকে বহিঃকেন্দ্রমন্ডল বা Outer Core বলে। বহিঃকেন্দ্রমন্ডল প্রধানত লোহা, নিকেল, সালফার ও অক্সিজেন দ্বারা গঠিত। বহিঃকেন্দ্রমন্ডলের গড় ঘনত্ব হল ৯.৯-১২.২ গ্রাম/ঘনসেমি। বহিঃকেন্দ্রমন্ডলের বাইরের অঞ্চলের উষ্ণতা হল ২৭৩০-৪২৩০ ডিগ্রি C এবং ভেতরের অঞ্চলের উষ্ণতা হল ৩৭৩০-৭৭৩০ ডিগ্রি C। বহিঃকেন্দ্রমন্ডলের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের গড় শক্তি হল ২৫ G (Gauss), যা ভূপৃষ্ঠের চৌম্বকীয় শক্তির চেয়ে ৫০ গুণ বেশি। এই অঞ্চলে অতিরিক্ত সালফারের উপস্থিতির ফলে, পদার্থসমূহ গলনাঙ্কের কাছাকাছি থাকে। এই অঞ্চল তরল অবস্থাপ্রাপ্ত হওয়ায়, ভূকম্প তরঙ্গের গতিবেগ হ্রাস পায়। বহিঃকেন্দ্রমন্ডলের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র P Wave প্রবাহিত হয়, S Wave প্রবাহিত হয় না। এই অঞ্চলে P Wave এর গতিবেগ ৮-৯ কিমি/সেকেন্ড। বহিঃকেন্দ্রমন্ডলের নিকেল লোহার তরলে বৃত্তাকার স্রোত পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। বহিঃকেন্দ্রমন্ডলের তরল ধাতবের পরিচলন স্রোত পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে, যা পৃথিবীকে সৌরঝড় থেকে রক্ষা করে।

    লেহম্যান বিযুক্তিরেখাঃ-

    ভূগর্ভে যে পরিবর্তনশীল অঞ্চল ভূগর্ভস্থ দুটি স্তরকে পৃথক করে, তাকে বিযুক্তিরেখা বা Discontinuity Line বলে। বহিঃকেন্দ্রমন্ডল ও অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলের মাঝে একটি বিযুক্তিরেখা রয়েছে, যা লেহম্যান বিযুক্তিরেখা (Lehmann Discontinuity Line) নামে পরিচিত। ভূগর্ভে ৫১৫০ কিমি গভীরতায় এই বিযুক্তিরেখা দেখা যায়। ১৯৩৬ সালে ড্যানিশ ভূতত্ত্ববিদ ইঙ্গে লেহম্যান এটি আবিষ্কার করেন। তাই তার নাম অনুসারে এটি লেহম্যান বিযুক্তিরেখা নামে পরিচিত। এই বিযুক্তিরেখাকে বুলেন বিযুক্তিরেখাও বলা হয়।

    ২) অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলঃ- 

    ভূগর্ভে  ৫১৫০-৬৩৭১ কিমি গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত কেন্দ্রমন্ডলের কঠিন অবস্থাপ্রাপ্ত অংশটিকে অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডল বা Inner Core বলে। অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডল প্রধানত লোহা (৮৫%)ও নিকেল (১০%) এর অ্যালয় এবং অল্প পরিমানে সিলিকা  রূপ কিছু হালকা ধাতু (৫%)  দ্বারা গঠিত। অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলের গড় ঘনত্ব হল ১২.৬ -১৩.৬ গ্রাম/ঘনসেমি। অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলের উষ্ণতা ৫৪০০-৫৫০০ ডিগ্রি C। বর্তমানে, সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায়, অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলের উষ্ণতা প্রায় ৫৯৫০-৬৪৫০ ডিগ্রি C ( "Melting of Iron at Earth's Inner Core Boundary Based on Fast X-ray Diffraction" --  S. Anzellini; A. Dewaele; M. Mezouar; P. Loubeyre & G. Morard -- Science Journal, 2013)। অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডল হল সবচেয়ে  ঘনত্বযুক্ত ও উষ্ণতম অঞ্চল। এই অঞ্চলে অত্যধিক উষ্ণতা সত্ত্বেও পদার্থসমূহ কঠিন অবস্থায় রয়েছে, এই অঞ্চলের অত্যধিক চাপের জন্য। ১৯৩৬ সালে ইঙ্গে লেহম্যান অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডল আবিষ্কার করেন। ১৯৭১ সালে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমানিত হয়, অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডল কঠিন অবস্থায় রয়েছে। অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলে P Wave এর গতিবেগ ১১-১১.৫ কিমি/সেকেন্ড। এই অঞ্চলে S Wave প্রবাহিত হয় না।  অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলে চাপের পরিমান ৩৩০-৩৬০ গিগাপ্যাসকেল। আধুনিক গবেষণা দ্বারা জানা গেছে, অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডল একাধিক বৃহৎ গাঠনিক চাঁই দ্বারা গঠিত এবং ঘনত্ব ও অনুভূমিক উষ্ণতা বন্টনে বৈষম্য দেখা যায়। আধুনিক গবেষণা থেকে বোঝা যায়, কঠিন অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডল একাধিক স্তরে সজ্জিত রয়েছে এবং ২৫০-৪০০ কিমি পুরু একটি পরিবর্তনশীল অঞ্চল (Transition Zone) দ্বারা পৃথক রয়েছে ( "Seismic structure near the inner core-outer core boundary" -- Kazuro Hirahara; Toshiki Ohtaki & Yasuhiro Yoshida -- American Geophysical Union, 1994)। অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলের শীতলীকরন হার অনুসারে হিসেব করে দেখা গেছে, পৃথিবীর অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলটি গলিত অবস্থা থেকে কঠিন হতে শুরু করে ০.৫-২ বিলিয়ন বছর আগে।
    Previous Post Next Post