হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণসমূহ | Reasons for the decline of the Harappan civilization

হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণসমূহ | Reasons for the decline of the Harappan civilization

 


হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণসমূহ

দীর্ঘকাল উজ্জ্বল উপস্থিতির পর আনুমানিক 1700 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটে। হরপ্পা সভ্যতার মত এত প্রাণবন্ত সভ্যতা কি কারনে লুপ্ত হয় তা সঠিক ভাবে আজও জানা যায়নি। অধিকাংশ পণ্ডিতদের মতে হরপ্পা সভ্যতার অন্তর্গত বিভিন্ন শহরের ধ্বংস বিভিন্ন কারণে ঘটে ছিল। আধুনিক প্রায় সকল গবেষক বিষয়ে একমত যে সিন্ধু সভ্যতার পতন ক্রমান্বয়ে ঘটেছিল।

প্রাকৃতিক কারণ গুলির মধ্যে সিন্ধু অঞ্চলের জলবায়ুর পরিবর্তন সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের জন্য দায়ী ছিল বলা যায়।মার্টিমার হুইলার মনে করেন যে, একদা সিন্ধু উপত্যকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো কিন্তু পরবর্তীকালে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে বৃষ্টিপাত খুবই কমে যায়। ফলে সিন্ধু অঞ্চলে মরুভূমির বিস্তার ঘটে, মাটিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যায় ফলে কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হয় এবং খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হয়। মার্টিমার হুইলার আরো বলেন যে হরপ্পা নগর গুলিতে প্রচুর পোড়া ইটের দরকার হয়। এই ইট পোড়াবার জন্য স্থানীয় বন জঙ্গল কেটে ধ্বংস করা হয় ফলে বৃষ্টিপাত কমে যায় ও শুস্কতা বৃদ্ধি পাই। সিন্ধু উপত্যকায় ক্রমে মরুভূমির প্রসার ঘটে। ফলে স্থানটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

অনেকের মতে সিন্ধু ও তার শাখানদী একসময় গতিপথ পরিবর্তন করলে হরপ্পা সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। জলের অভাবে সিন্ধু ও সরস্বতী নদী শুকিয়ে যায়। জলের অভাব ও শুস্কতা বৃদ্ধির ফলে মহেঞ্জোদারো ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে মহেঞ্জোদারো তার গুরুত্ব হারায়।


ম্যাকে, রাইয়কস, এস আর রাও,দয়ারাম সাহানি প্রমূখ ইতিহাসবিদ মনে করেন যে বিধ্বংসী বন্যার ফলে হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল। মহেঞ্জোদারোতে দেখা যায় যে বন্যার জল থেকে নগরকে রক্ষার জন্য 50 ফুট চওড়া বাঁধ দেওয়া হয়, বন্যার জল আটকাতে বাড়ির ভিত উঁচু করা হয়, বাড়ির যে অংশ বন্যার জল লাগতে পারে সেই অংশটা পোড়া ইট দ্বারা তৈরি করা হয়। এগুলোর কোনোটিই সভ্যতাটিকে বিধ্বংসী বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি।

নাগরিকতা বোধের অভাবও এই সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী ছিল। হরপ্পা সভ্যতার যে সাতটি স্তর বিন্যাস দেখা যায় তার ওপরে স্তর গুলিতে চূড়ান্ত নাগরিকতা বোধের অভাব দেখা যায়। রাস্তা অবরোধ করে গৃহনির্মাণ, গলি অবরোধ করে ইঁটের পাঁজা নির্মাণ, নর্দমা অপরিষ্কার, বড় বড় কক্ষগুলো ক্ষুদ্র কক্ষে ভাগ করা ইত্যাদি নাগরিক আদর্শের অবনতির পরিচয় বহন করে। মার্টিমার হুইলার বলেছেন যে পরবর্তী যুগের মহেঞ্জোদারো ছিল দরিদ্র ও হতশ্রী

কেউ কেউ মনে করেন হরপ্পা নগরের লোকেরা ছিল রক্ষণশীল তারা নতুন কিছু শিখতে চাইতো না। যুগের পরিবর্তনের সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে চাইতো না।হরপ্পা বাসীরা খাল খননের কোনো চেষ্টা করেনি, গাঙ্গেয় উপত্যাকার উর্বর জমিতে তারা কৃষি সম্প্রসারণ এর কোনো উদ্যোগ নেয়নি, নিজেদের আত্মরক্ষার্থে কোন ভারী অস্ত্র নির্মাণ করার কথা তারা ভাবেনি। এমনকি বৈদেশিক বাণিজ্য ক্রমে কমতে থাকলেও তারা কোনো বিকল্প পথ খোঁজার চেষ্টা করেনি। তাই রক্ষণশীল মানসিকতার জন্য এই সভ্যতার পতন ঘটেছিল বলে অনেকে মনে করেন।

মার্টিমার হুইলার, ডি. ডি কোসাম্বি প্রমূখ পন্ডিত মনে করেন যে বহিরাগত আর্য জাতির আক্রমণের ফলে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। ঋকবেদে ইন্দ্রদেবতা 'পুরন্দর বা পুরের ধ্বংসকারী' বলে অভিহিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পুর বলতে সিন্ধু সভ্যতার নগর গুলির কথা বলা হয়েছে বলে মনে করা হয়। মহেঞ্জোদারোতে কুপের ধারে পড়ে থাকা নরকঙ্কাল গুলির খুলিতে ধারালো অস্ত্রের দাগ এবং মৃতদেহগুলি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকা ইঙ্গিত দেয় যে আকস্মিক আক্রমণের ফলে এই নগর সভ্যতা ধ্বংস হয়।

সিন্ধু সভ্যতার অবলুপ্তির কারণ হিসেবে বিভিন্ন তত্ত্বের কথা উপস্থাপনের পর এই কথা বলায় যে উল্লেখিত কোন তত্ত্ব ত্রুটি মুক্ত নয়। তাই যতদিন পর্যন্ত হরপ্পা সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।



Reference:
  • ভারত ইতিহাস পরিক্রমা - পি. মাইতি ও এ.কে মন্ডল
  • ভারতের ইতিহাস - জে. মুখোপাধ্যায়

Previous Post Next Post